ফের জোটবদ্ধ হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত?
রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০০:১৬; আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:২২
ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা ও নির্বাচনী তফসিল বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের মাঠে পুরনো মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে আবারো সঙ্গী করার একটি উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি।
রাজনীতির মাঠে কয়েক বছরের বিচ্ছেদের পর কাছে টানার এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে দল দুটির মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।
তবে এবার তাদের সম্পর্ক কেমন হবে কিংবা এটি জোট গঠন পর্যন্ত যাবে কি-না তা নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসেনি বলছেন দল দুটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম জানান, এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাদের আলোচনা শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, একটি প্রক্রিয়া বা আলোচনা শুরু হয়েছে বলা যায়। তবে কী হবে এখনি বলতে পারছি না। এ বিষয়ে আর কিছু বলা ঠিক হবে না।
তবে বিএনপি নেতারা এ নিয়ে এখনি মুখ খুলতে রাজী নন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, তারা চান বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যেন একতরফা নির্বাচন না করতে পারে, সেজন্য একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠুক।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য যারাই ৭ জানুয়ারির একদলীয় নির্বাচন বর্জন করছে, তাদের সবাইকেই আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে করে জনগণের দাবি অর্জনে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা যায়।
তবে বিএনপির এই জাতীয় ঐক্যের চিন্তায় সামিল করতে জামায়াতের সাথে কোন আলোচনা হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব তিনি দেননি।
দলটির স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, জামায়াত তো বিএনপির মতোই আন্দোলন করছে। এর বাইরে আর কিছু হলে সেটা ভবিষ্যতে জানতে পারবেন।
বিএনপির নেতৃত্ব চারদলীয় জোটে জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারেও ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকেই সরে আসে দলটি।
এখন আবার যেসব দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত আছে তাদের ‘এক জায়গায়’ আনার চিন্তা করছে বিএনপি, যার মূল উদ্দেশ্য ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে শক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।
রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, জামায়াত বিএনপির পুরনো ও বিশ্বস্ত মিত্র। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সমালোচনার মুখে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লেও এখন বিএনপি হয়তো দেখবে তার সাথে কারা থাকলে তার আন্দোলনে বেশি লাভ হবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে বিএনপি বেশি বিবেচনা করতে পারে।
জোট নাকি যুগপৎ?
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে যে তথ্য পাওয়া গেছে সেটি হলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলন করছে সেটিকে আরও জোরদার করার মাধ্যমে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে ঠেকানো যায় তার সন্ধান করছেন তারা।
এজন্য সরকার বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে এক প্ল্যাটফর্মে বা একই ছাতার নিচে আনাকেই জরুরি বলে মনে করছেন তারা। এ চিন্তা থেকেই দলীয় হাইকমান্ডের পরামর্শে দলটির কয়েকজন সিনিয়র নেতা এ নিয়ে কাজ শুরু করছেন।
এরই অংশ হিসেবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য একজন সদস্য গত কয়েকদিনের মধ্যে জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথা বলেছেন।
উভয় পক্ষ আশা করছে আলোচনার মাধ্যমেই একটি প্রক্রিয়া বের করা সম্ভব হবে যাতে করে বিএনপি এখন যাদের সাথে নিয়ে আন্দোলন করছে তাদেরকে একইভাবে রেখে জামায়াতকেও যুগপৎ আন্দোলনে সামিল করা যায়।
জামায়াত নেতা আব্দুল হালিম বলেন, বিএনপির সাথে ডান-বাম অনেকে আছে। অনেকগুলো দল যুগপৎ আন্দোলন করছে। এজন্যই আলোচনা হচ্ছে কীভাবে কী করা যায়। আপাতত এর বাইরে আর কিছু বলতে পারছি না।
জানা গেছে, জামায়াতকে নিয়ে জোট করার ব্যাপারে বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বাম ধারার দলগুলোর তীব্র আপত্তি আছে।
সে কারণেই জামায়াতকে কীভাবে বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত করা হবে, তা নিয়ে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করেই এগুতে চায় বিএনপি।
সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, যারাই সরকারের সাথে নেই বা নির্বাচনে যায়নি তাদের সবাইকে নিয়ে ঐক্য করাটা এখন দেশের মানুষ চায় বলে তারা মনে করেন। কিন্তু তারা কীভাবে সেটি করতে চান তার কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি।
মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, যুগপৎ একটা আইওয়াশ বরং আন্দোলনে এক জায়গায় আসলে বিএনপি ও জামায়াত এক হয়েই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাবে।
তিনি বলেন, জামায়াত ছাড়া বিএনপি দুর্বল এটা অনেকেই মনে করেন। এখন বিএনপিও ভাবতে পারে যে চলমান আন্দোলনে কারা তার সাথে থাকলে তার লক্ষ্য অর্জনে বেশি কাজে লাগবে। সে চিন্তা থেকে হয়তো তারা জামায়াতকে আবার কাছে টানার চিন্তা করতে পারে।
যে কারণে জামায়াত-বিএনপি দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ
বিএনপির গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের দিন জামায়াতও ঢাকায় সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। এরপর থেকে বিএনপি যখন যেই কর্মসূচি পালন করছে সেই একই ধরনের কর্মসূচি আলাদাভাবে জামায়াতও ঘোষণা করে যাচ্ছে।
আবার নির্বাচনী রাজনীতিতে সক্রিয় ধর্মভিত্তিক আরেকটি দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অনেকদিন সরকারি বলয়ে থাকলেও গত কয়েক মাস ধরে সরকার বিরোধী অবস্থান নিতে শুরু করে।
শেষ পর্যন্ত তারাও বিএনপির পথ অনুসরণ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির একটি অংশ জামায়াত ও ইসলামি আন্দোলনকে তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে শরীক করানো যায় কি-না তা নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত করলে দল থেকে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ইসলামী আন্দোলনের নেতারা আগেই জানিয়েছেন, তারা আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনা করেই তাদের পদক্ষেপ নেবে। তবে জামায়াতের দিক থেকে তেমন কোনো বক্তব্য না দিয়েই তারা বিএনপির মতো করেই কর্মসূচি ঘোষণা করে যাচ্ছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে বা নির্বাচনকে নিয়ে নিজেদের দাবি অর্জনে তেমন কোনো সফলতা বিএনপি আনতে পারেনি। এ কারণেই লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন চাইছেন নির্বাচনে যায়নি এমন সব দলকে এক জায়গায় নিয়ে আসার একটি প্রক্রিয়া বের করতে।
দলের নেতারাও অনেকে মনে করেন আলাদা থেকে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করাটা এখন খুব একটা সহজ কাজ হবে না।
সে কারণে এক সময় যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতকে জোটে রাখা নিয়ে বিএনপি দ্বিধান্বিত হয়ে উঠলেও এখন আর সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেও দলের অনেকে মনে করেন।
মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, বিএনপি আগেও বারবার বলেছে যে জামায়াতের সাথে তার সখ্যতা আদর্শিক নয় বরং তাদের জোট একটি নির্বাচনী জোট।
তিনি বলেন, বিএনপির সাথে জামায়াত থাকলে তাদের শক্তি বেশি হয়, এটা পরিষ্কার। জামায়াত ছেড়ে যে বিএনপি দুর্বল হয়েছে সেটা তো দলটির অনেকে মনে করেন। তবে এটাও ঠিক এতদিন যারা বিএনপির সাথে মিলে আন্দোলনে ছিল তাদের ম্যানেজ করে কীভাবে জামায়াতকে এক জায়গায় নিয়ে আসে বিএনপি সেটাই হবে দেখার বিষয়।
যেভাবে শুরু বিএনপি-জামায়াত জোট
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে ১৯৭৭ সালে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে তারা।
বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সেই নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল বিএনপি এবং এরপর থেকে দল দুটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে হতে ৯৯ সালের শুরুতে এসে আনুষ্ঠানিক জোটে রূপ নেয়।
তখন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামি ঐক্যজোটকে নিয়ে চার দলীয় জোট গঠন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি।
এই জোটই ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় জায়গা পান জামায়াতের দুই নেতা- মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ।
তারা দুজনই পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন।
ওদিকে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটও পরে বিশ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।
২০১৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করলে জামায়াতও সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে।
আবার ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব বিএনপিসহ কয়েকটি দল যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করেছিল সেখানে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন জামায়াত দলীয় প্রার্থীরা।
কারণ ওই বছরেই দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এটি করা হয়েছিল ২০১৩ সালের অগাস্টে দেওয়া হাইকোর্টের একটি রায়ের ভিত্তিতে। পরে হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত লিভ টু আপিল করলেও আদালত তা খারিজ করে দিয়েছিল।
এমনকি ২০১৩ সালের নয় ফেব্রুয়ারির পর প্রায় এক দশক ঢাকায় কোনো সমাবেশের অনুমতি পায়নি জামায়াত। দীর্ঘ এ বিরতির পর চলতি বছর দশই জুন ঢাকায় দলটি সমাবেশের আয়োজন করে আলোচনায় এসেছিল।
মূলত ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে জামায়াত ইসলামী রাজনৈতিকভাবে কার্যত কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে যায়। এখন নির্বাচন ইস্যুতে দলটি আবার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে বলে অনেকে মনে করেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: