টিউশনির টাকায় বিসিএস প্রস্তুতি, পররাষ্ট্র ক্যাডার হলেন রাবির সোহেল রানা

রাবি প্রতিনিধি: | প্রকাশিত: ৮ জুলাই ২০২৫ ১৮:০০; আপডেট: ৮ জুলাই ২০২৫ ২৩:১৭

- ছবি - ইন্টারনেট

মো. সোহেল রানা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের একজন সাবেক শিক্ষার্থী। পারিবারিক অবস্থা ভালো না থাকায় টিউশনির টাকায় নিয়েছেন বিসিএস প্রস্তুতি, হয়েছেন পররাষ্ট্র ক্যাডার।

অসংখ্য প্রতিকূলতা পেরিয়ে তার এই অর্জন, বিশেষ করে পরিবারের প্রতি তার গভীর দায়বদ্ধতা এবং নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন। চলুন জেনে নেওয়া যাক তার সংগ্রামের গল্প।

নওগাঁর মহাদেবপুরে বেড়ে ওঠা সোহেল তার বাবা-মা এবং দুই বোনসহ পাঁচজনের ছোট পরিবারে সবার ছোট। মহাদেবপুরের জাহাঙ্গীরপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় ২০১৪ সালে, যখন তার বাবা আকস্মিকভাবে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান। বাবার অসুস্থতা তাদের পরিবারকে কঠিন আর্থিক সংকটে ফেলে দেয় এবং সেই সময় থেকেই সোহেলকে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে টিউশনির পথ বেছে নিতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই সোহেলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তিনি বলেন, “বাবা তো অন্ধ, পরিবারের অবস্থাও ভালো ছিলো না। টিউশন করিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। এমনকি ৫টা টিউশনও করেছি। রাজশাহীতে টিউশন পাওয়া যায় না সহজে, টাকার পরিমাণও কম। তারপরও অনেক খুঁজে ম্যানেজ করেছি।” পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনির চাপ সামলানো ছিল তার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল স্নাতক শেষ করার পরের তিন-চার বছর, যখন তিনি বেকার ছিলেন। এই সময়ে সমাজের নানা কটু কথা তাকে মানসিক যন্ত্রণা দিত। তিনি বলেন, “অনেকে অনেক কথা বলেছে। আত্মীয়-স্বজনরা বলতো কি ব্যাপার? পড়াশোনা শেষ, চাকরি কবে করবা? তখন কিছু বলতে পারিনি। বলতাম চেষ্টা করছি, দোয়া রাখবেন। পরিবার থেকেও শুনতে হয়েছে যে সবাই চাকরি করে, তুই কী করিস?” এই বেকারত্ব তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। পরীক্ষার জন্য বার বার ঢাকা যাওয়া এবং বই কেনার খরচ জোগাতেও তাকে হিমশিম খেতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনার প্রতি ততটা মনোযোগী না হলেও, স্নাতক শেষে তার বন্ধুরা তাকে চাকরির প্রস্তুতির পরামর্শ দেন। ২০২১ সালে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি রাজশাহীতে ফিরে পুরোদমে বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রস্তুতির সময়ও তাকে টিউশন করাতে হয়েছে, যা তার প্রস্তুতির জন্য দৈনিক ৪-৫ ঘণ্টা কেড়ে নিত। অনেকবারই তার মনে হয়েছে যে তার পক্ষে বিসিএস পাশ করা সম্ভব নয়। প্রিলি বা অন্যান্য পরীক্ষায় ভালো ফল না এলে হতাশায় ভেঙে পড়েছেন তিনি। বন্ধু-বান্ধবরা যখন চাকরি পাচ্ছিল বা বিদেশ যাচ্ছিল, তখন তার নিজের কিছু না হওয়াটা তাকে কষ্ট দিত।

সোহেলের অনুপ্রেরণা ছিল মূলত অন্যদের সাফল্য। তিনি বলেন, “বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখতাম অনেকে প্রথম হচ্ছে, অনেক সিনিয়ররা চাকরি পাচ্ছে। এগুলো দেখে নিজেকে মোটিভেট করতাম যে ওরা পারলে আমি কেন পারব না। এটা ভেবেই পড়াশোনা করেছি যে রিজিকে থাকলে পারব, ইনশাআল্লাহ।” প্রিলি বা রিটেনের আগে তিনি দিনে ১০-১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন।

৪৩তম বিসিএসে সোহেল শিক্ষা ক্যাডার পেয়ে নওগাঁর সাপাহার সরকারি কলেজে যোগদান করেন। আর গত ৩০ জুন প্রকাশিত ৪৪তম বিসিএসের ফলাফলে তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, যা তার দীর্ঘদিনের সংগ্রামের এক সার্থক পরিণতি।

নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সোহেল বলেন, “অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যাবে না। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সবাই অনেক খুশি। বাবা-মা অনেক খুশি। আমার ওয়াইফও অনেক খুশি। সবার থেকে ভালো রেসপন্স পাচ্ছি।”

একজন রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে সোহেলের এখন প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজগুলো, বিশেষ করে প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাকরি নিয়োগ ও যাতায়াত সহজ করা এবং বিদেশে গিয়ে যেন তারা সহজে কাজ পান, তা নিশ্চিত করতে চান।

তার এই সফলতার পেছনে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। সোহেল তার বন্ধুদের সাথে সবকিছু শেয়ার করতেন এবং একসাথে পড়াশোনা ও কোচিং করতেন। বাবা-মায়ের দোয়ার কারণেই তিনি আজ এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন বলে জানান।

যারা আগামীতে বিসিএস দিতে আগ্রহী, তাদের উদ্দেশ্যে সোহেলের বার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট:

“ডেডিকেশন থাকতে হবে, ফোকাস থাকতে হবে। সরকারি চাকরি, বিসিএস বা ব্যাংক জব যদি কেউ করতে চায়, সেই মোতাবেক আগাতে হবে। অবশ্যই কোনো পিছুটান থাকা যাবে না। এখন যে কম্পিটিশন, দিনে অবশ্যই ৮-১০ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হবে।”



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top