শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় কর্মবিরতি; নেপথ্যে রাকসু বানচালের চেষ্টা

রাবি প্রতিনিধি: | প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:৩৪; আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:২৫

- ছবি - ইন্টারনেট

শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাকে ঘিরে সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এদিকে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট নির্বাচন তারিখ ঘোষণা করা হলেও শিক্ষকের লাঞ্ছিতের ঘটনাকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী পূর্ণদিবস কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন।

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে এক ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, প্রার্থী ও সমর্থকরা ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত। এমন এক সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা এবং পরবর্তী অচলাবস্থা সন্দেহজনক বলে মনে করছেন অনেকেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু জেষ্ঠ্য অধ্যাপক মনে করছেন, এই ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাকসু নির্বাচন বানচালের একটি পরিকল্পনা কাজ করছে।

অনুসন্ধান করে জানা যায়, শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে এর পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে—রাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পূর্বপরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে এ আন্দোলনের ডাক দেন তারা।

এর আগে, রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীবের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পোষ্য কোটা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা সমিতি।

এদিকে সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তেও আস্থা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। তাদের দাবি কিছুটা মানা হলেও আন্দোলনে অনড় রয়েছেন তারা।

প্রথমে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দাবি ছিল, শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় যেসব ছাত্র জড়িত তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা এবং পোষ্য কোটা বহাল রাখা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জরুরি সিন্ডিকেট সভার আহবান করেন এবং সেখানে শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন প্রশাসন এবং পোষ্য কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে আপাতত স্থগিত করা হয়।

শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দাবির আলোকে সিদ্ধান্ত আসলেও কেন তারা বিশ্ববিদ্যালয় কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন? এমন প্রশ্ন এখন সকলের মাঝে। তাহলে কি তারা শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনাকে সামনে রেখে কোনো একটি উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছেন? শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্দোলনের ফলে ঘেরা কলে পড়ছেন রাকসু নির্বাচন এবং এর সাথে জড়িত প্রার্থী ও ভোটাররা।

এদিকে আজ বেলা ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাব রাবি শাখার সভাপতি অধ্যাপক ড. মামুনুর রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান, দাবি না মানা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে কর্মবিরতিতে থাকবেন তারা।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, কর্মকর্তাদের কমপ্লিট শাটডাউনে ঘোষণা জানেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের কাছে পাঠানো হয়নি কোনো অফিশিয়াল চিঠি। ফলে সকাল থেকে কর্মস্থলে কর্তব্য পালন করছেন তারা। প্রশ্ন তাহলে কারা ডেকেছেন এ আন্দোলন? শিক্ষার্থীদের রাকসুর আমেজ নষ্ট করতেই এ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে বলে জানান রাকসুর প্রার্থীরা।

নাম বলতে অনিচ্ছুক এমন এক কর্মকর্তার সাথে কথা হয়। তিনি জানান, পোষ্য কোটার বিষয়টি আদালতে রিট করা হয়েছে। একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই আসবে। তবে রাকসুকে সামনে রেখে এমন আন্দোলন যৌক্তিক না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা হয়েও আন্দোলনে অংশগ্রহণের ডাক পাইনি। তাহলে কি এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আয়োজনের আন্দোলন—যারা রাকসু বানচালের জন্য এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তারা ভাবছেন এ আন্দোলন ডাক দিলে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে এবং শিক্ষার্থীরাও চলে যাবে আর এদিকে বন্ধ হয়ে যাবে রাকসু এটাই তাদের আসল উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে আমার কাছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা শিক্ষক লাঞ্ছিতের বিচার চেয়ে ছিলাম তা সিন্ডিকেট সিদ্ধান্তের আলোকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এবং পোষ্য কোটা পুনর্বহাল তাও কিন্তু বাতিল না করে আপাতত স্থগিত করা হয়েছে তাহলে কেন এ আন্দোলনের ডাক? আপনারা এর পিছনের কারণ বের করুন। আমি গতকালও অফিস করেছি, আজও করছি ও আগামীকালও করব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অফিসার সমিতির (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি মোক্তার হোসেন বিষয়টি বলেন, ‌সিন্ডিকেটে পোষ্য কোটা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত বহাল রাখায় আমরা হতাশ। এছাড়াও শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় তদন্ত কমিটির দিকে আমাদের বিশ্বাস নেই। আমরা দ্রুত ওই ঘটনার সাথে জড়িত শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিল চাই। রাকসু রাকসুর মতোই অনুষ্ঠিত হবে। রাকসু বানচালের নিয়ে যারা কথা তুলছেন সেই অবশ্যই অবান্তর বলে জানান তিনি।

এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতির ফলে স্থবির হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। ফলে পরীক্ষাসহ রুটিন ক্লাস বন্ধ থাকছে এবং শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে থেমে নেই রাকসুর প্রচারণা। সকাল থেকেই প্রার্থীদের পুরোদমে প্রচারণা করতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদল মনোনীত রাকসুর ভিপি পদপ্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবীর বলেন, পোষ্য কোটা ইস্যুতে রাকসুকে বানচালের চেষ্টা করছে একটি মহল। তাদের ষড়যন্ত্র হচ্ছে এ আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে ভয় ডুকিয়ে দেওয়া। এবং সেটি হচ্ছে যার ফলে শিক্ষার্থীরা কিন্তু অনেকেই বাসায় চলে যাচ্ছেন। আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচন চাই না। যাদেরকে কেন্দ্র করে নির্বাচন তাদেরকে নিয়েই নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করুক নির্বাচন কমিশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আদিপত্যবিরোধী ঐক্যজোট প্যানেলের জিএস প্রার্থী সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, যেসব শিক্ষক- কর্মকর্তারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তারা একদিকে চাচ্ছেন পোষ্য কোটা ফিরিয়ে আনতে অন্যদিকে করছেন রাকসু বানচালের পায়তারা। কারণ তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর রাকসু নির্বাচনে লড়ার সেই কনফিডেন্সটুকু নেই বলে আমি মনে করি। তারা পুরো ক্যাম্পাস কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেছেন কারণ শিক্ষার্থীরা যেন বাসায় চলে যান এবং সেটাই হচ্ছে। তবে তাদের ষড়যন্ত্র শিক্ষার্থীরা বুঝে ফেলেছে। রাবি শিক্ষার্থীরা অবশ্যই রাকসু নির্বাচন সঠিক সময়ে আদায় করে নেবে।

ছাত্রশিবির মনোনীত সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের রাকসুর ভিপি পদপ্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন প্রশাসন। এর পরেও তারা কেন এমন করছেন সেটা সবারই বোধগম্য। পোষ্য কোটার ফিরিয়ে আনার চেয়েও রাকসু বানচাল নিয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন কিছু সংখ্যাক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তবে রাকসু বানচালের ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত তা শিক্ষার্থীদের বুঝতে আর বাকি নেই বলে আমি মনে করি।

বামপন্থি সংগঠনের ভিপি পদপ্রার্থী ফুয়াদ রাতুল বলেন, আমরা সবসময় উৎসব মুখর পরিবেশে রাকসু নির্বাচন চেয়েছিলাম। রাকসু নির্বাচন যদি পিছানো হয় তাহলে আগেই তফসিল ঘোষণা দিয়ে আমাদেরকে জানাতে হবে। রাকসু বানচাল ও ষড়যন্ত্র শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই মেনে নেবে না।

এ বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউট্যাবের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন বাবু বলেন, আমরা রাকসু নিয়ে কথা বলতে চাইনা। রাকসু নির্বাচন আমাদের এখতিয়ারে নেই। শিক্ষকের গায়ে হাত দেওয়ায় আমরা আজ মানববন্ধন করেছি। এ আন্দোলনের ফলে একদল হয়তো বলছে রাকসু বানচালের চেষ্টা চলছে যা অবান্তর ও ভিত্তিহীন। আমরা চাই আমাদের শিক্ষকের উপর হামলা হয়েছে সেটি নিয়েই থাকতে।

রাকসু বানচালের বিষয়ে জানতে চাইলে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, কারা নির্বাচন চাচ্ছেন, কারা চাচ্ছেন না সে বিষয়ে আমরা কিছু বলবো না। আমরা চাই সঠিক সময়ে রাকসু নির্বাচন। তবে শিক্ষক কর্মকর্তাদের আন্দোলনে রাকসু নির্বাচনে প্রভাব পড়ছে। কমপ্লিট শাটডাউনে থাকায় শিক্ষার্থীরা অনেকেই বাসায় যাচ্ছেন। এ বিষয়টি খুব চিন্তার ও উদ্যেগের। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি বলে জানান তিনি।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top