দেবর-ভাবির পুরনো দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:৩৬; আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:৪৮

ছবি: সংগৃহীত

প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় এসে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। আবারও প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে এরশাদের স্ত্রী ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও এরশাদের ভাই দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের মধ্যে। দলের ভেতর পদ নিয়ে চলে আসা দেবর-ভাবির পুরনো দ্বন্দ্ব এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। নতুন করে দেখা দেওয়া দ্বন্দ্বের ১৫ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যেও স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। রওশনপন্থি ও কাদেরপন্থি নেতাকর্মীদের নাম সামনে চলে আসছে। ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন দুই পক্ষের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতারা।

বিশেষ করে ব্যাংকক থেকে রওশন এরশাদের কাউন্সিল ডাকাকে কেন্দ্র করে দলে ভবিষ্যৎ ভাঙনের আশঙ্কাও করছেন জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারা। তারা বলেছেন, দ্বন্দ্বের অবসান না হলে দল রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দুই ভাগে ভাগ হতে পারে। জাপার একাধিক নেতা বলেছেন, জাপার রাজধানীর পুরানা পল্টনের পুরনো অফিসে রওশন এরশাদ কার্যালয় করছেন। এর জন্য ওই অফিসের দুইটা ফ্লোর ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেখানেই রওশনপন্থি নেতাকর্মীরা বসবেন। এ মাসের শেষ সপ্তাহে রওশন এরশাদের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। দেশে ফিরে এ কার্যালয় থেকেই দলের ১০ম জাতীয় কাউন্সিলের কাজ পুরোদমে শুরু করবেন বলেও জানা গেছে।

দলের ভেতর দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করেছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি গতকাল সোমবার বলেন, ‘জাপার ভেতর একটা কোন্দল চলছে সেটা দৃশ্যমান। দেবর-ভাবি ঠিক হয়ে গেলেই কোন্দল নিরসনে আমাদের কোনো উদ্যোগ নিতে হয় না। তারা ঠিক হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’

এ ব্যাপারে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, ‘আমরা চাই সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। দল জিএম কাদেরের নেতৃত্বেই চলবে। রওশন এরশাদের বয়স যদি কম হতো, শক্তিসামর্থ্য থাকত, তাহলে আমরাই বলতাম রওশন এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যান হোক। রওশন এরশাদের সে অবস্থা নেই। আমি রওশন এরশাদকে মায়ের মতো ভালোবাসি। কিন্তু তার পক্ষে তো দল চালানো সম্ভব না।’

কেন এই নতুন দ্বন্দ্ব : জাপায় এই নতুন দ্বন্দ্ব-বিবাদের জন্য দলের নেতারা আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কারণ হিসেবে দেখছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ভেতর ও বাইরে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এরশাদের জীবদ্দশায়ও সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কয়েকবার বিভক্তির কবলে পড়েছিল দলটি। শেষ অবধি এরশাদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন এবং দলকেও বিভক্তি থেকে রক্ষা করেছেন। এরশাদের মৃত্যুর পর এবারই প্রথম সেই পুরনো সংকটে পড়তে যাচ্ছে জাপা।

এ ব্যাপারে দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই দলের ভেতর কোন্দল। বাইরে থেকে ও ভেতরের কিছু সুবিধাবাদী লোকজন এটা করছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ চাইছে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপা আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকুক বা জোট করুক ও নির্বাচনে অংশ নিক। কারণ রওশন এরশাদের ওপর সরকারের আস্থা রয়েছে। তারা জাপার রাজনীতিতে জিএম কাদেরকে কখনোই আস্থায় নিতে পারেননি।’

সেই ক্ষেত্রে জিএম কাদের কী করবেনÑ জানতে চাইলে দলের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, তাদের সঙ্গে এ নিয়ে জিএম কাদেরের একাধিকবার কথা হয়েছে। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের সিদ্ধান্তে দৃঢ়। দলের আদর্শ মেনেই তিনি সরকারের ভুল কাজ ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। এ জন্য ভবিষ্যতে তিনি জেলে যেতেও প্রস্তুত। কিন্তু সৎ ও আদর্শের পথেই থাকতে চান। আগামী দিনে যেন মানুষ বলতে পারে জিএম কাদের ঠিক ছিলেন।

৩১ আগস্টের চিঠিতেই শুরু : ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর দেবর-ভাবির প্রথম দ্বন্দ্ব দেখা দেয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া নিয়ে। এ জন্য স্পিকারকে পাল্টাপাল্টি চিঠি দেন রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের। শেষ পর্যন্ত দলের ভেতরে সমঝোতায় রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হন। দ্বিতীয় দফায় দ্বন্দ্ব দেখা দেয় নবম জাতীয় কাউন্সিলে। সে কাউন্সিলে রওশন এরশাদের জন্য আলাদা পদ সৃষ্টি করে ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ করা হয়। এরপর রওশন এরশাদ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। প্রায় ১০ মাস ধরে থাইল্যান্ডের ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। এমন অবস্থায় গত ৩১ আগস্ট ব্যাংকক থেকেই দলের ১০ম জাতীয় কাউন্সিল ডাকার মধ্য দিয়েই নতুন করে আলোচনায় আসেন এবং দলে দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব আবার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

৩১ আগস্ট গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। সেখানে আগামী ২৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে জাপার ১০ম জাতীয় সম্মেলন ডাকেন রওশন এরশাদ। সেই সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেন। যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় জাপার ছয়জন কো-চেয়ারম্যানকে। সদস্য সচিব করা হয় গোলাম মসীহকে।

এই সম্মেলন ডাকার মধ্য দিয়েই জাপার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসে। সে রাতেই রওশন এরশাদের এই আহ্বায়ক কমিটি গঠনকে সম্পূর্ণ অবৈধ, অনৈতিক ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে জানান জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। কিন্তু সে সম্মেলনকে স্বাগত জানান জাপা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেওয়া এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। বর্তমানে তিনি জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

রওশনের ডাকা সম্মেলন হবে কি : রওশন এরশাদের সম্মেলন ডাকার এখতিয়ার নেই বলে জানিয়েছেন জি এম কাদের। এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটি গঠন ও কাউন্সিল ঘোষণার কোনো এখতিয়ার নেই জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষকের। কাউন্সিলে গঠিত একটি বৈধ কমিটি ভেঙে দেওয়ার কোনো ক্ষমতা জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ছাড়া আর কারও নেই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শুধু জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান আহ্বায়ক কমিটি গঠন এবং জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করতে পারেন।

এমনকি রওশন এরশাদ সম্মেলন প্রস্তুত কমিটিতে যে ছয়জনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করেছেন, তাদের মধ্যে পাঁচজন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি এবং অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি আহ্বায়ক কমিটি গঠন ও জাতীয় পার্টির কাউন্সিল ঘোষণার বিষয়ে অবগত নন বলেও জানান জিএম কাদের।

এমন পরিস্থিতিতে রওশন এরশাদের ডাকা সম্মেলন আদৌ হবে কি না এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে দলের মধ্যে। এ ব্যাপারে দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, কাউন্সিলে বাধা আসতে পারে। যুব সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতারা এখনো এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কাউন্সিলের দিকে নজর রাখছেন।

তবে দলের এক প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘রওশন এরশাদ কাউন্সিল ডেকে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু ও কাজী ফিরোজ রশীদকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তারা বলেছেন দায়িত্ব পালন করবেন না। তা হলে সে কাউন্সিল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

কে হচ্ছেন বিরোধীদলীয় নেতা : রওশন এরশাদের সম্মেলন ডাকার পরদিনই জাপার পার্লামেন্টারি পার্টি বৈঠক করে রওশন এরশাদের পরিবর্তে জিএম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেয়। স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার আগে ওইদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সংসদ ভবনে জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক হয়। বৈঠকে জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর জাপার প্রেসিডিয়ামের বৈঠকেও জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মনোনীত করা হয়। কিন্তু গতকাল সোমবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি স্পিকার।

এ ব্যাপারে সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, স্পিকার দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি দেশে ফিরলেই সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমরা তার অপেক্ষায় আছি।

তবে জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করা হবে না বলে মনে করছেন জাপার অনেক নেতা। তারা বলেন, কারণ জিএম কাদেরকে সরকার আস্থায় নিতে পারেনি। ফলে রওশন এরশাদকেই রাখবে। এ সংক্রান্ত জাপার আবেদন ঝুলিয়ে রাখা হবে এবং এটাকে কেন্দ্র করেও রাজনীতি হবে।

কার পক্ষে কারা : জাপার নেতারা জানান, রওশন এরশাদের ডাকা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেউ কাউকে এখন আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। তবে এখনো জিএম কাদেরের পাল্লা ভারী।

এ ব্যাপারে দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, তৃণমূলের ৯৮ শতাংশ নেতাকর্মী জিএম কাদেরের পক্ষে। রংপুরে যেটা জাপার ঘাঁটি, সেখানে সবাই জিএম কাদেরের পক্ষে। রংপুরে দু’একজন আছেন, যারা এমপি হওয়ার জন্য রওশন এরশাদের পক্ষ নিয়েছেন। এখন যদি রওশনের নেতৃত্বে একটা জোট হয়, তখন এমপি হওয়ার এক সম্ভাবনা থাকে। তারা এমপি হতে পারবেন। এ ধরনের লোকগুলোই এখন রওশন এরশাদের পক্ষে মার্চ করছেন।

এই প্রেসিডিয়াম সদস্য আরও বলেন, রওশন এরশাদের এখন বয়স হয়ে গেছে। তিনি এখন তার ছেলে সাদ এরশাদের কথা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান হবেন সাদ এরশাদ। গোলাম মসীহ বা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তারা কখনোই সাদ এরশাদের অধীনে রাজনীতি করবেন না। তা হলে রওশন এরশাদের অংশ চলবে কী করে?

আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলে ভাঙনও আসতে পারে। যারা সহজেই এমপি হতে চান, তারা চাইছেন কাউন্সিল হোক। কো-চেয়ারম্যানদের মধ্যে দু’তিন জন ছাড়া সবাই জিএম কাদেরের সঙ্গেই থাকবেন। ওই দু’তিনজন রওশন এরশাদের পক্ষে যেতে পারেন। কারণ এরা কেউ সর্বশেষ প্রেসিডিয়াম সভায় আসেননি।

কী চান জিএম কাদের : এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাপার একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, জিএম কাদের কিছুতেই বিএনপির সঙ্গে যাবেন না। তিনি স্বাধীনতার সপক্ষের সৈনিক এবং সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করেন। বিএনপির যেহেতু জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে লিয়াজোঁ আছে, তাই তিনি নিজে আলাদা জোট করতে পারেন। তবে আগামী নির্বাচনে ইভিএম ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সরকার সে কারণে জিএম কাদেরকে আস্থায় নিতে পারছে না। জিএম কাদেরের মূল শর্ত আগামী নির্বাচনে ৬০-৭০ আসন দিতে হবে। এ শর্ত পূরণ হলে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধলেও বাঁধতে পারেন। কারণ জাপায় আওয়ামী লীগের পক্ষের লোকজন জিএম কাদেরেরও ঘনিষ্ঠ।

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top