কবি জি এম হারূন : নিরব অভিমানেই চলে গেলেন

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ | প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৩১; আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ২১:০৬

কবি জি এম হারূন। ছবি ফাইল

কবি জি এম হারূন ইন্তেকাল করেছেন গত ১০ এপ্রিল রাত পৌণে এগারোটায়। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। খবরটি তেমন কেউ জানে না। একান্ত নিরবে প্রস্থান করেছেন তিনি। ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার কেশরহাটে তাঁকে দাফন করা হয়।

বাংলাসাহিত্যপ্রেমীদের কাছে বেশ পরিচিত একটি নাম জি এম হারূন। লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন ছাত্র জীবন থেকেই। প্রথম লেখা হিসেবে ছড়া ছাপা হয়েছে ১৯৬৫ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। সেই থেকে চলছে নিরবচ্ছিন্ন কলম সংগ্রাম। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ সাহিত্যে প্রায় সকল শাখায় বিরোচিত বিচরণ তাঁর। বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনার পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করলেও কলমপেশা থেকে থেকে অবসরের কোন সুযোগ গ্রহণ করেননি তিনি। বরং এখন আরো বেশি সরব হয়েছেন সাহিত্যের অঙ্গনে।

কবি জি এম হারূন জন্মগ্রহণ করেছেন বগুড়া শহরের বাদুতলা মহল্লায় ১৯৪৮ সালে। বৃটিশবিরোধী আন্দোলন তাঁর চোখে না পড়লেও ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান শাসক বিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তব স্বাক্ষী তিনি। এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সকল অনিয়ম ও অস্থিরতার বিরুদ্ধে তার কলমসহ সুউচ্চকণ্ঠ তাঁকে একজন প্রতিবাদী কবিস্বত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জি এম হারূন অনেকাংশেই স্বভাব কবি। খুব অল্পসময়ে একসাথে অনেক ছড়া-কবিতা লিখতে পারেন তিনি। তবে লেখার পরে তাতে কাটা ছেঁড়ার অভ্যাসটা খুব বেশি নেই তার। ইতোমধ্যে তাঁর তিয়াত্তরখানা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে ভালবাসার একদিন, মগ্ন রবো মাটির প্রেমে, স্বরচিহ্নে কলরব, মেঘের মাদল বাজে প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থসহ প্রায় বাইশটিরও বেশি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে।

কবি আল মাহমুদের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় (কবি জি এম হারূন ছবির বাম দিক থেকে প্রথমে) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ কলা ভবনে উপস্থিত ছিলেন। ছবি ফাইল। 

উপন্যাসেও কম যাননি জি এম হারূন। নীল চোখে নীল যন্ত্রনা, কন্ডাক্টর, চলো যাই নির্বাসনে, পোষাকী লেহাজ, গোধূলির পাখি, বেলা বয়ে যায়সহ চব্বিশটি উপন্যাস এবং টিকলি মামা, হরিবোসের আড্ডা, মৃত্তিকা ছুঁয়ে, চোখের আয়তনেসহ এগারোখানা গল্পগ্রন্থ লিখে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

নাটক লিখেছেন এবং অভিনয়ও করেছেন জি এম হারূন। তিনি নিজে একজন বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিবন্ধিত আর্টিস্ট হিসেবে যেমন কাজ করেন তেমনি ‘বিপ্লব এবং খৃস্টান সন্ধান, মুন্সির হাট, সপুরার দিনকালসহ ছয়খানা নাট্যগ্রন্থও প্রকাশ করেছেন।

কবিতা ও কথাসাহিত্য তাঁকে মজ্জাগতভাবে পরিচিত করলেও ছড়া সাহিত্যে তিনি অনেক এগিয়ে। শিশুতোষ, বড়তোষ, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গোলামীর বিরুদ্ধে তার ছড়া গর্জে উঠেছে সব সময়। ছড়াবোল, কেচ্ছাকান্ড, হেই সামালো, সা রে গা মা, একবস্তা ছড়া, বত্রিশ ভাজা, লিমেরিক, এক্কা দোক্কা ছক্কা ছড়া, এই তাল ছড়া তাল, ছড়াছড়ি প্রভৃত তাঁর উল্লেখযোগ্য ছড়াগ্রন্থ।

ছোটকাগজ সম্পদনা মানেই অন্যের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে পথপাড়ি দেয়া। এ গুরুদায়িত্ব পালনেও তিনি পিছিয়ে নেই। তূণ, আঁচল, অবসর, প্রজন্ম, সাহিত্য ভূবন, সঙ্গীত ভূবন, ছড়াবাজ এবং পুস্পকাব্য নামে তিনি সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন। তিনি অন্যের বোঝা কাঁধে নিয়ে অবশ্য রিক্তহস্তে অবসর জীবনে ফিরে আসেননি। যেমন আছে তাঁর ভক্তবৃন্দ তেমনি স্বীকৃতিস্বরুপ পঞ্চান্নটি পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন তিনি।

কবি জিএম হারূনের দুএকটি ছড়া এমন-

মাটির কসম
আমার ভিটায় ঘুঘু চরে
তোমার ভিটায় শালিক
জুলুমকারী তুমি এখন
আমার ভিটার মালিক!

ছেলে আমার যুদ্ধে গেছে
আসুক আগে ফিরে
তখন তোমায় দেব সাজা
মাটির কসম কীরে।

পবিত্র জীবন
পুঁটি মারি কাতলা মারি
মারি চিতল মারিরে
ইলিশ মারি কাড়ি কাড়ি
মারি বোয়াল মারিরে।

ফুল কুমারী ফুলেশ্বরী
জুঁই চামেলী বেলী
রঙ বেরঙের আহামরি
দেখি নয়ন মেলি।

মানুষ যদি ফুলের মত
গড়তো তণু মন
ধন্য হত মানব জনম
ধন্য এ জীবন।

কবি জিএম হারূন সারাদেশের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে অবাধ বিচরণ করলেও নির্মম সত্য হচ্ছে তাঁর মৃত্যুর খবরটাও তেমন কোন মিডিয়াতে আসলো না। এমনকি হাজার হাজার সখ্যসুধি থাকলেও স্যোশাল মিডিয়াতেও তেমন কোন খবর প্রকাশ পায়নি। আমরা ক্রমশ অসামাজিক হতে চলেছ কি না ভাবা উচিৎ।

(লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।)



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top