দ্বীনি-ইলম শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

শাহ্ সুফী মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৫১; আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০৮

ফাইল ছবি

পরম করুণাময় মহান আল্লাহ্ তায়ালা জ্বীন এবং মানবজাতি সৃষ্টি করেছেন বিশেষ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। তা হলো উভয় জাতি কেবলমাত্র এক আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদত করবে এবং গাইরুল্লাহ্’র ইবাদত বর্জন করবে। শুধুমাত্র মহান আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদত এবং গাইরুল্লাহ্র ইবাদত বর্জন করতে হলে বান্দাকে জানতে হবে, কোনটি আল্লাহ্র ইবাদত আর কোনটি গাইরুল্লাহ। এজন্য মহান রব্বের পক্ষ হতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের ওপর ইল্ম অর্জন করা বাধ্যতামূলক (ফরজ) করেছেন। যার কারণে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে জ্ঞানার্জনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আবার হাদীসের প্রায় সকল কিতাবে কিতাবুল ইলম্ বা জ্ঞানার্জন বিষয়ক অধ্যায়ও রয়েছে। যাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এঁর মুখ নিঃসৃত শত শত ইল্ম সম্পর্কিত অমীয় বাণী (হাদীস) বর্ণনা করা হয়েছে। আর ঈমানদার ব্যক্তি ইল্ম-ওয়ালা বা আলেম (জ্ঞানী) হবেন এটাই ঈমানের অন্যতম দাবি।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর উপর হেরা গুহায় সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হয়- ‘পাঠ করো, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক (জমাট রক্তপিন্ড) হতে। পাঠ করো আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতো না।’ জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রশংসায় মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন, ‘এ সকল দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য দেই, কিন্তু কেবল জ্ঞানী ব্যক্তিরাই ইহা বুঝে’। ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেবল দু’জন ব্যক্তি ঈর্ষার পাত্র। সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তাকে তা সৎপথে ব্যয় করার শক্তিও দিয়েছেন। আর সেই লোক যাকে আল্লাহ্ জ্ঞান-বুদ্ধি দান করেছেন, যার বদৌলতে সে বিচার-ফায়সালা করে থাকে ও তা অপরকে শিক্ষা দেয়।’ এখানে ঈর্ষা বলতে, অপরের ধন ও জ্ঞান দেখে মনে মনে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা। সেই সাথে এই কামনা থাকে না যে, অপরের ধ্বংস হয়ে যাক। হযরত আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে; যাতে সে বিদ্যা অর্জন করে, আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।’ ইল্মে দ্বীন শিক্ষার কতো গুরুত্ব এ সকল আয়াত ও হাদীস থেকে তা উপলব্ধি করা যায়।

ইলম আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো জানা, বুঝা, জ্ঞান, বিদ্যা, সত্য, শাস্ত্র, বিজ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি ইত্যাদি। দুনিয়ার জীবনে মানুষের জন্য হক ও বাতিল, হেদায়েত ও গোমরাহির মাঝে পার্থক্য করে হককে গ্রহণ ও হেদায়েতের ওপর অটল-অবিচল থাকা আবশ্যক। এজন্য প্রত্যেকে ব্যক্তির যথেষ্ট পরিমাণ প্রয়োজনীয় দ্বীনের ইলম বা জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ইলমে ফরায়েজ ও কোরআন শিক্ষা কর। কেননা আমাকে উঠিয়ে নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়।’ মহান আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইল্ম অর্জনের প্রতি তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘মু’মিনদের সকলের এক সঙ্গে অভিযানে বাহির হওয়া সংগত নয়। উহাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ বহির্গত হয়না কেন, যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে যাতে তারা সতর্ক হয়।’ আয়াতটির সরল অনুবাদ হচ্ছে- ‘আর মুমিনদের সবার জন্য একসঙ্গে বেরিয়ে পড়া যেহেতু সম্ভব নয়, তাই প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি উপদল কেন বের হয় না, যাতে তারা ইল্মে দীন শিক্ষা করবে এবং (শিক্ষা সমাপ্ত করে) ফিরে এসে তারা তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করবে, যাতে তারা (সম্প্রদায়) পাপ থেকে বিরত থাকে।’ আর বান্দাদের নির্দেশ করে বলেন, ‘অতএব তুমি আল্লাহ্রই ইবাদত কর এ্রবং কৃতজ্ঞ হও।’

বান্দা কিভাবে ইলম অর্জন করবে এবং ইবাদত কেমন হবে এ বিষয়ে মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- ‘আমি এই কুরআনে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহন করে।’ তাই রাব্বুল আলামীন ইল্ম অর্জনকারী একজন বান্দার মর্যাদা বোঝাতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষনা করেন- ‘(হে নবী!) বলুন, যারা জানে এবং যারা জানেনা, তারা কি সমান?

সাধারণত দ্বীনী ইল্ম বলতে আমরা শুধুমাত্র কুরআন-হাদীস শিক্ষা বা চর্চাকে বুঝে থাকি। কিন্তু প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদগণ দ্বীনী ইল্ম বলতে ইহজীবনে বেঁচে থাকার সার্বিক কর্মকান্ড কিভাবে পরিচালনা করতে হবে বা ইহজীবনের সার্বিক কর্মকান্ড কিভাবে চলবে তা জানার জন্য আল্লাহ্র হুকুম-আহকাম শিক্ষা করা এবং এর মধ্য দিয়ে পরকালীন জীবনেও আল্লাহ্র অনুগ্রহ প্রাপ্তি কিভাবে লাভ হয় সে শিক্ষাই হচ্ছে দ্বীনী ইলম। তবে দ্বীনী ইল্মের ফযীলত লাভের জন্য পূর্বশর্ত হল: ইখলাছ যা শুধুমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। যা পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে অর্জনে বা আমল করা যাবেনা। আর পার্থিব সুনাম ও সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে দ্বীনী ইল্ম অর্জন করা হলে তার পরিণামও হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। পবিত্র হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে, ‘জাহান্নামে সর্বপ্রথম নিক্ষিপ্ত তিন ব্যক্তির একজন হবে ঐ আলিম, যে লোকের কাছে আলেম হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জন্য ইল্ম চর্চা করেছে।’ আবার, ‘যে দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন ইল্ম শিখলো, যা শুধু আল্লাহ্র জন্যই শেখা হয় সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুঘ্রানও পাবে না।’

মানবজাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ্র হুকুম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর সুন্নাহ কুরআন ও হাদীসের আলোকে সঠিক ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী চিন্তাধারা চলমান ও পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দেয়া আলিমদের অন্যতম গুরুত্ববহ একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক প্রজন্মের ন্যায়-নিষ্ঠ লোকেরা দ্বীনের এই ইল্মকে ধারণ করবে। তারা সীমালংঘনকারীদের বিকৃতি, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে একে রক্ষা করবে।’

আমাদের মেধা, আয়ু ও সামর্থ্য সীমিত। তাই একই ব্যক্তি সকল বিষয় শিখবে এবং তাতে পারদর্শী হবে এটা সম্ভব নয়। পবিত্র ইসলাম ধর্মের দিক নির্দেশনাও হচ্ছে প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ে সমাজের কিছু কিছু লোক পারদর্শী হবে এবং প্রত্যেকেই তার শিক্ষার মাধ্যমে অন্যকে সাহায্য করবে। এভাবে পুরো সমাজ একটি ইউনিটের ন্যায় হবে। মানুষের বিভিন্ন বৈচিত্রতা সত্ত্বেও যে বিষয়টি সবাইকে মেলবন্ধনে আবদ্ধ রাখবে তা হচ্ছে ঈমান এবং পবিত্র ইসলাম ধর্মের দেখানো পথের ভ্রাতৃত্ববোধ। আবার কর্মক্ষেত্র ভিন্ন হলেও সবার বিশ্বাস ও আদর্শ হবে অভিন্ন এবং এ আদর্শিক অভিন্নতার ভিত্তিতেই সকল মুসলমান হবে ভাই ভাই। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার রূপরেখা এটাই। মুসলিম জাতি যখন বিজয়ীর আসনে ছিল তখন তাদের শিক্ষা ও সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনই ছিল। মুসলমান যদি গৌরবময় অতীত ফিরে পেতে চায় তবে তাদের সকলকে এ পন্থা অনুকরণ ও অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

লেখকঃ শাহ্ সুফী মহিব্বুল আরেফিন

সাংবাদিক ও সুফী গবেষক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top