বাদ্যের হাটে শারদ সুর

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪৩; আপডেট: ৪ মে ২০২৪ ১৯:৫২

ছবি: প্রতীকী

ঢাক-ঢোল-কাঁসর ছাড়া পূজা-অর্চনার কথা ভাবা যায় না। আরতি ও ধুনুচি নাচে দারুণ সঙ্গ দেয় ঢাক। সিলেট শহরের চৌহাট্টা, শেখঘাট, কাজীর বাজার এলাকায় রয়েছে বাদ্যযন্ত্র তৈরির বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাদ্যযন্ত্রের হাটে কারিগরদের ব্যস্ত সময় কেটেছে। সম্প্রতি হাট ঘুরে এসে লিখেছেন শিশির কুমার নাথ

শরৎ আলোয় আনন্দের ঝলকানি। শারদ উৎসবের সুরে বাদ্যযন্ত্রের ঝিমিয়ে পড়া হাটগুলোতে ছন্দ ফিরেছে। পূজার বাদ্যের খুটখাট, টুংটাং শব্দ বাতাসে ভাসছে। দোকানের পাশের গলি পথ দিয়ে চলা পথচারীদের কানে সেই শব্দ উৎসবের আগমনী বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। সিলেট শহরের বাদ্যযন্ত্রের হাটে কারিগরদের ব্যস্ততা ছিল কিছুটা বেশি। অবসরের যেন ফুরসত নেই। শেষ সময়ের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন সবাই। নগরের চৌহাট্টা, শেখঘাট, কাজীর বাজার এলাকায় রয়েছে বাদ্যযন্ত্র তৈরির বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি হাট ঘুরে দেখা গেল, ক্রেতারা কেউ এসেছেন পূজার জন্য নতুন ঢাক-ঢোল কিনতে, কেউ এসেছেন পুরোনো যন্ত্রে চামড়ার ছাউনি করাতে। কারিগররাও ব্যস্ত নতুন কাজের ফরমায়েশ সময়মতো প্রস্তুত করতে। ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে ঢাক মেরামত করাতে এসেছেন সুরঞ্জিত। জানালেন, দাম এবার কিছুটা বেশি। ঢাক-ঢোল পূজার আরতির প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। তাই মেরামত করাতেই হবে। দু’পাশে চামড়ার নতুন ছাউনিতে ৩ হাজার টাকা খরচ হবে। তা ছাড়া নতুন একটি খোলও তিনি নিয়েছেন, যার দাম পড়েছে ৪ হাজার টাকা।

নগরের শেখঘাট এলাকার একটি ভবনের দোতলায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মনিকা তবলা’। ভেতরে প্রস্তুত করে রাখা সারি সারি বাদ্যযন্ত্র। প্রতিষ্ঠানের অধিকারী রিপন দাস একটি খোলের সুর চড়া করতে দোয়ালি (বেল্ট) টানছেন। পরক্ষণেই আঙুল ঠুঁকে দেখছেন টিউন ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। পাশেই রেখেছেন একটি ঢোলের ছাউনিবিহীন কাঠের খোল। বললেন, এটি প্রস্তুত করে লন্ডনে পাঠাতে হবে। এ নিয়ে তাঁর ১৮টি ঢোল লন্ডনে গেল। কাজের হাত ভালো; তাই অনেকেই শখের বাদ্যটির জন্য আসেন রিপন দাসের কাছে। তিনিও দরদ দিয়ে কাজ করেন। ভালো কাজ করলে লোকজনের কাছে নামডাক হবে, পেশাও বাঁচিয়ে রাখা যাবে। এমনটি বিশ্বাস করেন তিনি। প্রায় বিশ বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত রিপন দাস। বাবার কাছেই হাতেখড়ি। বাবা গোপাল দাসও দক্ষ কারিগর। বাবা ও ছোট ভাই সুমনকে নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাক, ঢোল, ঢোলক, তবলা, শ্রীখোল, হাতবায়া, খমক, জিপসি, নাল প্রভৃতি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠানে। মানভেদে যন্ত্রের দাম কম-বেশি হয়। একটি ঢাক ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা, ঢোল ৬ থেকে ১৫ হাজার, তবলা ৩ থেকে ৬ হাজার, খোল ১ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। খোলের মধ্যে আবার রাশি খোলের দাম কম। ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় রাশি খোল পাওয়া যায়। তবে ‘বান্ধা খোল’ নামে যে ভালো মানের খোল রয়েছে, তার দাম ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। সামনের শীত মৌসুমে খোলের চাহিদা বাড়বে। কীর্তনের আসরে সঙ্গ দিতে খোলের বিকল্প নেই। তাই কিছু বাড়তি খোল তৈরি করে রাখা হয়েছে। শ্রীখোলে মাটির চাড়া (খোল) ব্যবহৃত হয়। এসব মাটির চাড়া বা খোল আসে টাঙ্গাইল থেকে। খোলের শব্দ অনেকটা তবলার মতোই। সরু অংশে চড়া সুর আর মোটা অংশে গম্ভীর। এসব সুর তুলতেও বেশ কায়দা-কসরতের প্রয়োজন বলে জানান রিপন। চামড়ার ওপর মাটি, লোহার গুঁড়া ও ভাত মিশিয়ে প্রলেপ দিতে হয়। তার পর একটু একটু করে রোদে তাপ দিতে হয়। মেঘাচ্ছন্ন দিনে খোলের কাজ করা যায় না। ঢাক-ঢোল তৈরির প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। পিপার মতো কাঠের খোলবিশেষের দুই পাশে বাঁশ অথবা লোহার চাকা সহযোগে চামড়ার ছানি দেওয়া হয়। চামড়ার চিকন দোয়ালি বা বেল্ট লাগিয়ে চামড়াকে টানা দেওয়া হয়। কড়ই, মান্দার কাঠে ঢাক-ঢোল হলেও আম কাঠেই বেশি ভালো হয়। হাতে খোদাই করা কাঠের খোল কিনতে হয় মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল এসব জায়গা থেকে। ঢোলের একমুখে থাকে গরু বা মহিষের মোটা চামড়া, অন্য প্রান্তে থাকে ছাগলের পাতলা চামড়া। এতে মোটা ও চিকন শব্দে তালে তালে ঢোল বাজে। ঢোলের খোলটির পিঠে চামড়ার দড়ির টানা থাকে। এই টানাতে পিতলের কড়া লাগানো থাকে। কড়া সামনে বা পেছনে টেনে ঢোলের সুর বাঁধা হয়। ঢাকের এক প্রান্তে কাঠি দিয়ে বাজানো হয়। ঢাক তৈরিতে লাগে খাসির চামড়া। এসব চামড়ার বেশির ভাগই আসে নাটোর থেকে। একটি ঢাক অথবা ঢোল প্রস্তুত করতে ৭-৮ দিন সময় লাগে। রিপন দাসের মূল বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে থিতু হয়েছেন সিলেট শহরে। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। নিজে লেখাপড়া বেশিদূর এগিয়ে নিতে না পারলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। জানালেন, জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা আগের মতো নেই। চামড়ার দামও বাড়তি। কিন্তু ক্রেতার কাছে খুব বেশি দাম চাওয়া যায় না। মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। তাতে ভালোমতো সংসার চালানো কঠিন। দুর্গাপূজা এলে কিছুটা বিক্রি বাড়ে।

নগরের চৌহাট্টার ‘দিলীপ বাদ্যযন্ত্রের দোকান’ নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী দিলীপ বাবু। ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি ঢোলক মেরামতে ব্যস্ত। ঢোলক ঢোলের চেয়ে আকারে ছোট। দু’দিকের ব্যাস সমান, চামড়া তুলনামূলকভাবে পাতলা। ঢোলক বাজাতে কোনো কাঠি লাগে না, হাত দিয়েই বাজানো হয়। ঢোলক বেশি ব্যবহৃত হয় নাটক ও যাত্রাপালা, কাওয়ালি, শিবের গান ও পদ্মপুরাণ গানে। দিলীপ জানালেন, প্রায় ৪০ বছর আগে এ কাজে লেগেছেন। এটি তাদের পৈতৃক পেশা। তিনি বাবার কাছ থেকে শিখেছেন। ঢোলক ছাড়াও ঢাক-ঢোল, তবলা, খোল সবই তৈরি করতে পারেন। তাঁর তিন ছেলে এক মেয়ে। ছেলেরা অন্য কাজ করে। ভাইয়ের ছেলে তপন তাঁকে ব্যবসায় সহযোগিতা করেন। তপনও পূজার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

সিলেট অঞ্চলের গীতবাদ্য ও গীতিসাহিত্যভান্ডার সুপ্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ। এ অঞ্চলের ধামালি চৌপাড়া কীর্তন, গোপাল গোবিন্দ ভোগের গীতিনৃত্য, বাউলগান প্রাচীন নৃত্য-সংগীতের অমূল্য সম্পদ। বলা হয়, তৎকালীন শ্রীহট্টের রাজা গণেশ প্রথম মূর্তিতে দুর্গাপূজা করেন। যদিও এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবুও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এসব ধারা যে এ অঞ্চলের ধর্মোৎসবকে প্রভাবিত করেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। বহু সাধক পুরুষের জন্ম এই পীঠভূমিতে। বিভিন্ন রকম অধিবাসীর মধ্যে বাদ্যকর, গাইন, বাইন, ভাট বা ভট্টকবি সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতবাদ্যে সংশ্লিষ্টতা ছিল এসব সম্প্রদায়ের। পূজার মৌসুমে আবার ভ্রাম্যমাণ বাদ্য কারিগরদের দেখা মেলে। এক সময় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ীভাবে কারিগররা বাস করতেন। বাদ্য তৈরির বায়না পেলে তা শহরে নিয়ে গিয়ে মেরামত করে আবার লোকজনের বাড়ি পৌঁছে দিতেন। কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়েও মেরামত করে দেন। এখনও মাঝেমধ্যে এমন কারিগরের দেখা পাওয়া যায়। অনেকে আবার মণ্ডপে বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন। তাঁরাও দলবল নিয়ে নিয়মিত মহড়া দিচ্ছিলেন। কেউ কেউ হাটে এসে খবর নিচ্ছেন বায়না-বরাতের। খোকন ঢুলি নামে তেমনই একজনের দেখা পাওয়া গেল। বাউলগানের আসরে ঢোল বাজান খোকন। পাঁচ-ছয়জনের দল নিয়ে পুজোর চার দিন বাজালে ১৩০-৩৫ হাজার টাকা পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top